আত্মশুদ্ধির নান্দনিক মাধ্যম সাহিত্য

গাজী আবদুল্লাহ আল মাহমুদ.

সাহিত্য মস্তিষ্কে যতটুকু থাকে তার চেয়ে বেশি থাকে হৃদয়ে। এই কথাটি আমার নয়, বুদ্ধদেব গুহ’র। তিনি বলেছেন, সাহিত্য রচনায় মস্তিষ্কের তুলনায় হৃদয়ের ভূমিকা বড়। অর্থাৎ সাহিত্য রচনায় মস্তিষ্ক থেকে হৃদয় অধিক ভূমিকা পালন করে থাকে। সুযোগ বুঝে একটা বিষয় বলে রাখি, হৃদয় আর হৃদপিণ্ড কিন্তু এক জিনিস নয়। বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন হৃদপিণ্ডের আর ভাব-অনুভব, রাগ- অনুরাগ, আশা-আকাঙ্ক্ষার উৎপত্তি হয় হৃদয়ে। আশা করি হৃদয় আর হৃদপিণ্ডের আকাশ পাতাল পার্থক্য পরিস্কার হয়েছে। এই ব্যাবধান জানা সাহিত্যের জন্য অপরিহার্য। এখন প্রশ্ন আসছে, যে সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, সেটা আসলে কী?
ইন্দ্রিয় দ্বারা জাগতিক বা মহাজাগতিক চিন্তা চেতনা, অনুভূতি, সৌন্দর্য্য ও শিল্পের লিখিত প্রকাশ হচ্ছে সাহিত্য। সংক্ষিপ্ত বা এক কথায় বলা যায়, লিখন-শিল্পকে সাহিত্য বলা হয়। এবার অন্যভাবে বলি। মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, আস্থা-বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা, শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং ইতিহাস-ঐতিহ্য শৈল্পিক সৌন্দর্য নিয়ে যে মাধ্যমে প্রকাশিত হয়, সেই মাধ্যমের নাম সাহিত্য। একটি জাতি একটি রাষ্ট্রের জীবনপ্রণালির আক্ষরিক ছবির নাম সাহিত্য। এই সংজ্ঞা দিয়ে কী সাহিত্যকে চেনানো সম্ভব হল ? আমার মনে হয় না। যদিও একটি মিটিমিটি তারা দিয়ে বিশাল আকাশ চেনানো আর সংজ্ঞা দিয়ে সাহিত্য বোঝানো একই ধরনের ব্যর্থ চেষ্টার নামান্তর। তারপরেও চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। কেননা সাহিত্য মানুষকে সত্য উপলব্ধির পথ দেখায়। মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনকে সাহিত্যের মাধ্যমে অনুভব করা যায়। এ জন্যই সাহিত্য আত্মোপলব্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত। আত্মার যথার্থ উপলব্ধি অনুভব করা যায় সাহিত্য পাঠের মাধ্যমে। মহৎ সাহিত্য তাই কাল থেকে কালান্তরে পাঠক মনে দিয়েছে অপার তৃপ্তি। এ তৃপ্তি নিজেকে জানার, নিজেকে উপলব্ধি করতে পারার। নিজেকে জানা বা উপলব্ধি করার তৃপ্তি থেকে বঞ্চিত না হতে কবি কালীপ্রসন্ন ঘোষের “পারিব না” কবিতাকে স্মরণ করে অগ্রসর হতে চাই। কবি বলেছেন,
‘পারিব না’ একথাটি বলিও না আর,
কেন পারিবে না তাহা ভাব একবার;
পাঁচজনে পারে যাহা,
তুমিও পারিবে তাহা,
পার কি না পার কর যতন আবার
একবার না পারিলে দেখ শতবার।
ভাবগভীরতা, গীতিধর্মিতা চিত্ররূপময়তা, অধ্যাত্মচেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোম্যান্টিক সৌন্দর্যচেতনা, ভাব, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্য, বাস্তবচেতনা ও প্রগতিচেতনা সৃষ্টিতে সাহিত্যের বিকল্প কোন পথ নেই। প্রকৃত সাহিত্য-চর্চার প্রয়োজনে তার যথার্থ সংজ্ঞা জানা অপরিহার্য।
কবিগুরু ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, “বস্তুত বহিঃপ্রকৃতি এবং মানবচরিত্র মানুষের হৃদয়ের মধ্যে অনুক্ষণ যে আকার ধারণ করিতেছে, যে সংগীত ধ্বনিত করিয়া তুলিতেছে, ভাষায় রচিত সেই চিত্রই এবং গানই সাহিত্য।” সহিত শব্দ থেকে সাহিত্য শব্দের উৎপত্তি। একের সহিত অন্যের মিলনের মাধ্যমই সাহিত্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সাহিত্যের তাৎপর্য শিরোনামের প্রবন্ধে বলেছেন, ‘ সাহিত্যের সহজ অর্থ যা বুঝি সেটা হচ্ছে নৈকট্য – অর্থাৎ সম্মিলন।’
সাহিত্য একটি জাতির স্বরূপ অন্বেষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। না জেনে না বুঝে সাহিত্য চর্চা বাঞ্ছনীয় হবে না। সুদ্ধ সাহিত্য চর্চার জন্য সাহিত্যের প্রকৃত সংজ্ঞা জানা গুরুত্বপূর্ণ। সেকারণে নানা ভাবে ভিন্ন ভিন্ন আংঙ্গিকে সাহিত্যকে জানার বোঝার চেষ্টা করছি।
লেখক, সাংবাদিক আনিসুল হক তার কোন এক লেখায় সাহিত্য ও সাংবাদিকতার পার্থক্য বুঝাতে গিয়ে লিখেছিলেন, ভ্লাদিমির নবোকভ বলছেন, সেদিন সাহিত্য সৃষ্টি হয়নি, যেদিন সত্যিকারের বাঘ বন থেকে বেরিয়ে এসেছিল, আর রাখাল বালক বাঘ বাঘ বলে চিৎকার করেছিল। বরং সাহিত্য সেদিন সৃষ্টি হয়েছে, যেদিন কোনো বাঘ ছিল না, কিন্তু রাখাল বালক বাঘ বাঘ বলে চিৎকার করেছিল। ওই বাঘ ওই রাখাল বালকের কল্পনার সৃষ্টি। যখন বাঘ থাকে না, কিন্তু কেউ বাঘ বাঘ বলে চিৎকার করে, তখন সাহিত্য হয়। এই বনে একটা বাঘ আছে। আসলেই আছে। আমি বললাম যে, এই বনে বাঘ আছে, তা সাহিত্য নয়।কিন্তু যে বনে বাঘ নেই, সেই বন দেখিয়ে যদি আমি বলতে পারি, এই বনে বাঘ আছে, আর তা পাঠককে বিশ্বাস করাতে পারি, তাহলেই আমি সাহিত্য করলাম। প্রথমটা সাংবাদিকতা, দ্বিতীয়টা সাহিত্য।
হৃদয়, ভাষা ও কাঠামো এই তিনটা উপাদানের সমন্বয়ে সাহিত্য তৈরি হয়। সৃজনশীল-মননশীল বহু বিচিত্রতায় ভরপুর এই সাহিত্য। সাহিত্য চর্চা মানুষকে আধুনিক, মানবিক ও সার্বজনীন করে তোলে। সাহিত্য আত্মার কলুষতা দূর করে।
আত্মশুদ্ধির এক অনন্য মাধ্যম সাহিত্য। মানবিক উৎকৃষ্ট বৈশিষ্ট্য সাহিত্যচর্চার প্রধান উপকরণ। উপাদান আর উপকরণের গভির মিলনে সাহিত্য জন্ম নেয় পরিচ্ছন্ন হৃদয়ে। তাই হৃদয়স্পর্শী সাহিত্যের জন্য সুন্দর শুভ্র হৃদয়ের বিকল্প নেই।

অনুমতি ব্যতিত কপি করা থেকে বিরত থাকুন। -ধুনট বার্তা কর্তৃপক্ষ