ঝিনাইদহে ধর্মান্তরিত হওয়া জঙ্গী আব্দুল্লাহ আরো একটি বাড়ী নির্মাণ করছিল। শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দুরে কংশী গ্রামে ১০ শতক জমির উপর বাড়িটি নির্মাণের কাজ শুরু করেছিল সে। কংশী পূর্ব পাড়ার ফারুক হোসেনের কাছ থেকে দেড় মাস আগে সে ১০ শতক জমি ক্রয় করে। আলমসাধু (স্যালো ইঞ্জিন চালিত যান) চালিয়ে সাধারণভাবে জীবন যাপনের অধিকারী আব্দুল্লাহ একের পর এক জমি কিনে বাড়ি করার ঘটনায় তার আয়ের উৎস নিয়ে এলাকাবাসী মধ্যে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। জঙ্গী না হলে এত টাকা কোথায় পাচ্ছে তা নিয়ে ওই এলাকাবাসীর মধ্যে চলছে নানা আলোচনা ও সমালোচনা।
কংশী পূর্বপাড়ার ফারুক হোসেন জানান, তিনি শহরের একটি পেট্রোল পাম্পে কাজ করেন। গত দেড় মাস আগে আব্দুল্লাহ ১০ হাজার টাকা শতক দরে তার কাছ থেকে ১ লাখ টাকার বিনিময়ে ১০ শতক জমি কিনেন। এর কিছুদিন পর আব্দুল্লাহ তার নামে জমিটি রেজিস্ট্রে করে নেয়।
কংশী গ্রামের কাশেম ম-ল জানান, প্রায় ১৫ দিন আগে হঠাৎ করে তার বাড়ির সামনে ইট, বালি, বাঁশ ফেলতে থাকে এক ব্যক্তি। পরে দেখেন, তার বাড়ির সামনের জমিতে অপরিচিত এক ব্যক্তি পাকা বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করেছেন। কিন্তু যারা বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করেছিলেন তারা এলাকার পরিচিত রাজমিস্ত্রি ছিল না। ওই মিস্ত্রিদের এলাকার কেউ চিনেও না। মিস্ত্রিদের মধ্যে একজনের বাড়ি কুষ্টিয়ায় ও অপরজনের বাড়ি ঝিনাইদহ বাইপাসে বলে পরিচয় দিত। তবে কুষ্টিয়ায় কোথায় বাড়ি তা সে বলতো না।
অপরদিকে যার বাড়ি বাইপাসে সে আবার এলাকাবাসীর কাছে জানতে চাইতো ঝিনাইদহ বাইপাসে কিভাবে যাবো? ওই দুই মিস্ত্রিদের এসব কথা শুনে তাদের প্রতি সন্দেহ পোষন করে এলাকাবাসী। যদি তাদের বাড়ি কুষ্টিয়া বা বাইপাসে হবে তাহলে তারা ঝিনাইদহ বাইপাস চিনবে না কেন?
বয়স্ক কাশেম আরো জানান, মানুষ গ্রাম থেকে শহরে যেয়ে বাড়ি করে আর শহরের লোক গ্রামে এসে বাড়ি করছে দেখে তিনি আশ্চর্য হন। তিনি আরো জানান, যে মিস্ত্রিরা বাড়ি নির্মাণের কাজ করছিল তারা সেখানে টিনের ছাপড়ি (ঘর) করে থাকতো। কখনো তারা বাইরে বের হতো না। রাস্তায়ও আসতো না। এমনকি পাশের চা’র দোকানেও চা খেতে যেত না। এটা দেখে তাদের সন্দেহ হয় যে এরা কেমন মানুষ। সকালে ও সন্ধ্যায় এসে ওই বাড়ির মালিক (আব্দুল্লাহ) মটরসাইকেলে করে মিস্ত্রিদের ভাত দিয়ে যেত।
একই গ্রামের আব্দুর রহমান বলেন, আমি ওই মিস্ত্রিদের সাথে ডে লেবারের কাজ করতাম। সেখানে ৪ টি রুম ও দুই টি বাথরুম বিশিষ্ট বাড়িটি নির্মাণ করা হচ্ছিল। মিস্ত্রিরা কারো সাথে বেশি কথা বলতো না। কোথাও যেত না। রাতে ওই টিনের ছাপড়ার মধ্যে থাকতো। তারা অনেক টা আজম মানুষ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানান, শুক্রবার বিকেলে পোড়াহাটির ঠনঠনে পাড়ার জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের পূর্বে ওইদিন দুপুরে দুই মিস্ত্রি কাজ ফেলে দ্রুত গ্রাম ছেড়ে চলে যান। এর কয়েক ঘন্টা পর তিনি জানতে পারেন পোড়াহাটি আব্দুল্লাহ বাড়িতে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। তিনি ধারণা করেন, জঙ্গী সংশ্লিষ্টতার সাথে মিস্ত্রিরাও জড়িত। তা না হলে তারা দ্রুত পালিয়ে যাবে কেন?
অপরদিকে আব্দুল্লাহর মা সন্ধ্যা রানী জানান, তার তিন ছেলে। এদের মধ্যে প্রভাত ( আব্দুল্লাহ) সবার ছোট। প্রায় ১৫ বছর আগে সে পোড়াহাটির শরিফুলের তেল পাম্পে কাজ করতো। সে সময় তার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের সৃষ্টি হয় পার্শ্ববর্তী চুয়াডাঙ্গা গ্রামের আব্দুল লতিফের সাথে। ৯ বছর আগে জানতে পারেন তার ছেলে মুসলমান হয়েছে। কিন্তু জিজ্ঞাসা করলে বাড়িতে সে তা প্রকাশ করতো না। তার কয়েক বছর পর জানতে পারেন ছেলে আব্দুল্লাহ ওই বন্ধুর মেয়ে ফাতেমা ওরফে রুবিনাকে বিয়ে করেছে। ধর্মান্তরিত হবার পর আব্দুল্লাহর আচার আচরণে অনেক পরিবর্তন লক্ষ করে তারা। কথায় কথায় রাগসহ সকল কে মারপিট করতে উদ্যত্ত হতো।
এক পর্যায়ে ধানহাড়িয়া গ্রামের বাড়ি থেকে আব্দুল্লাহ জোর পূর্বক ৪ টি গরু, ৩ টি ছাগল নিয়ে যায়। এছাড়া ঘর-বাড়ি, জায়গা-জমি বিক্রি করার জন্য তার মা কে মারপিট করতো। জোর করে বাড়ির জমির দলিল নিয়ে নিত। সেই সময় তার সাথে চুয়াডাঙ্গা গ্রামের আতার ছেলে তুহিন বডিগার্ড হিসেবে থাকতো। একই কথা বলেন, আব্দুল্লাহর ভাই বিপুল বিশ্বাস। তারা অভিযোগ করেন প্রভাত কে ধর্মান্তরিত করে জঙ্গী বানানোর পিছনে চুয়াডাঙ্গা গ্রামের লতিফই দায়ি। বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে লতিফ তার মেয়েকে আব্দুল্লাহর সাথে বিয়ে দিয়েছে।
অপরদিকে চুয়াঙ্গায়া গ্রামের আব্দুল লতিফের বাড়িতে গিয়ে দেখে গেছে, সেখানে কেউ নেই। চারিদিকে ধান ক্ষেত আর ফাঁকা মাঠের মধ্যে লতিফের একটি ছাপড়ির বাড়ি রয়েছে। তার বাড়ির পাশে অন্য কারো বাড়ি-ঘর নেই। সেখানে যাওয়ার কোন রাস্তাও নেই। মাঠের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। বর্ষার সময় সেখানে পানি জমে।
এলাকাবাসী জানায়, লতিফ রিক্সা ও ভ্যান চালাতো। এলাকায় কারো সাথে সে মিশতো না। কোন ঝামেলায়ও জড়াতো না। তবে জঙ্গী আস্তানায় অভিযানের খবর পেয়ে সে পালিয়ে যায়। আর তার স্ত্রী মাজেদা খাতুনকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।
এদিকে পোড়াহাটির ঠনঠনে পাড়ার জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের পর ঝিনাইদহ সদর থানায় শনিবার একটি মামলা হয়েছে। আস্তানার মালিক আব্দুল্লাহ ও তার স্ত্রী ফাতেমা ওরফে রুবিনার নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরো ৮জনসহ ১০ জনের নামে মামলাটি হয়েছে। যার মামলা নং ৪৯। পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) প্রবীর কুমার বিশ্বাসকে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তবে তিনি মোবাইল ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত গত শুক্রবার (২২ এপ্রিল ২০১৭) বিকেল সাড়ে ৫ টার দিকে আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জঙ্গী আস্তানা সন্দেহে পোড়াহাটি গ্রামের আব্দুল্লাহর বাড়িটি ঘিরে রাখে। রাত সাড়ে ১০ টার দিকে পুলিশের খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি দিদার আহম্মেদ ভোর ৬ টা পর্যন্ত অভিযান স্থগিত ঘোষণা করেন। পরদিন অর্থাৎ গতকাল শনিবার সকাল সোয়া ৯ টা থেকে অপারেশন সাউথ প শুরু করেন। অপারেশন চলাকালে ওই বাড়ি থেকে থেকে ২০ ড্রাম হাইড্রেজেন পার অক্সাইড, ১৫ টি জিহাদী বই উদ্ধার করে। এ সময় ৫ দফায় ৫ টি শক্তিশালী বোমা নিস্ক্রিয় করে বোমা ডিসপোজাল ইউনিটের সদস্য।
অপারেশনে কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম, র্যাব, পুলিশ, পিবিআই, এলআইসি, বোমা ডিসপোজাল ইউনিট, খুলনা রেঞ্জ পুলিশসহ ৪ শতাধিক আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অংশ নেন।
অভিযান শেষে সেখান থেকে ২০ ড্রাম হাইড্রজেন পার অক্সাসাইড, ১০০ টি প্যাকেট লোহার বল, ৩টি সুইসাইডাল ভেষ্ট, ৯টি সুইসাইডাল বেল্ট, বিপুল পরিমান ইলেকট্রিক সার্কিট, ১৫ টি জিহাদী বই, ১ টি বিদেশী পিস্তল, ১টি ম্যাগজিন, ৭ রাউন্ড গুলি, ১টি মোটরসাইকেল, ১টি চাপাতি, বিপুল পরিমান বিস্ফোরক, ৬টি শক্তিশালী বোমা উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩টি সুইসাইডাল ভেষ্ট ও ২ টি বোম নিস্ক্রিয় করা হয় বলে ঘটনাস্থলে এক সংবাদ সম্মেলনে খুলনা রেঞ্জ ডিআইজি শেখ দিদার আহম্মেদ জানান। সংবাদ সম্মেলনের সময় খুলনা রেঞ্জের এডিশনাল ডিআইজি হাবিবুর রহমান, জেলা প্রশাসক মাহবুব আলম তালুকদার, পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আব্দুর রউফ মন্ডল, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজবাহার আলী শেখ, কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তা, বোম ডিস্পোজাল ইউনিটের প্রধানসহ গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।