আবদুল জলিল. কাজীপুর (সিরাজগঞ্জ) থেকে
চরগিরিশ। যমুনায় জেগে ওঠা চরের বসতিদের একটা গ্রাম। নদীর পাড় থেকে চরের শেষসীমা পর্যন্ত পুরো জায়গাটা সবুজ গালিচায় ছাওয়া। এরই মধ্যে কিছু কিছু জায়গা আবার একেবারে ন্যাড়া। সেখানে নারী-পুরুষ আর শিশুদের জটলা। একটু এগিয়ে দেখা যায় ওরা হাতে টেনে গাছগুলো টেনে তুলছে। গাছগুলোর শেকড়ে ঝুলছে থোকা থোকা বাদাম। বাদাম থেকে গাছগুলো আলাদা করে দিলেই সেগুলো হয়ে যাবে ওদের। তাই গাছ উপড়ানো নিয়ে চলছে জোর প্রতিযোগিতা। জমির মালিক সেলিম মোল্লা। তিনি জানান, কাজে ব্যস্ত লোকগুলোর সবাই পশ্চিম পারের বাসিন্দা, বাদাম তোলার কাজটা তাদের জন্য আনন্দের।
এবার যাওয়া যাক সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার যমুনার তীওে আরেকটি জায়গার নাম নাটুয়ারপাড়া। সেখানে কয়েকটি বাদামভিত্তিক কারখানায় এখন বেশ ব্যস্ততা। কয়েক শ নারীশ্রমিক বাদামের খোসা ছাড়ানোর কাজ করছেন। কাজ পেয়ে তারা খুশি। এখান থেকে ভাজা বাদাম, খোসা ছাড়ানো বাদাম ও মরিচ সিরাজগঞ্জ, বগুড়া ও জামালপুর সহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছে। যে যমুনা নদী বছরের পর বছর পাড় ভেঙে বেড়ায় নদী শিকস্তি লোকজনকে করেছে নিঃস্ব, আবার তারই বুকে জাগা চর ওই লোকগুলোর জন্য খুলে দিয়েছে সম্ভাবনার নতুন দ্বার। সমৃদ্ধি ধরা দিচ্ছে চরের চাষীদের হাতে। বাদাম সমৃদ্ধিও অন্যতম অনুষঙ্গ। চর এলাকার হাজার হাজার বিঘা জমিতে কেবল উন্নতমানের বাদামই উৎপন্ন হচ্ছে না, বিঘাপ্রতি যে পরিমাণ বাদাম উৎপন্ন হচ্ছে, তা দেশের অনেক অঞ্চলের চেয়ে বেশি। এ কারণে কাজীপুর উপজেলা ইতোমধ্যেই দেশের অন্যতম প্রধান বাদাম উৎপাদনকারী অঞ্চল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
উপযোগী জমি ঃ
বাদাম চাষে দরকার পলিমিশ্রিত বেলেমাটি। ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত বাদাম চাষের মৌসুম। কাজীপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মামুনুর রহমান জানান, সামান্য বর্ষাতেই কাজীপুরের চর এলাকার সব জমি যমুনার পানিতে তলিয়ে যায়। আর বড় বন্যা হলে তো কথাই নেই। প্রতিবছর উপজেলার চর এলাকার জমিতে জমে প্রচুর পলি ও বালি। আর তা-ই বাদাম চাষের জন্য অন্যন্ত উপযোগী। উপজেলার ১২ টির মধ্যে খাসরাজবাড়ী, নাটুয়ারপাড়া, তেকানী, নিশ্চিন্তপুর, চরগিরিশ, মনসুরনগর, মাইজবাড়ী, কাজিপুর সদর ও শুভগাছা নামের এ ৯টি ইউনিয়নের মানুষের প্রধান আয়ের উৎসের একটি হচ্ছে বাদাম। কৃষি অফিস জানায়, এ ৯টি ইউনিয়নের ৭৮০ হেক্টর জমিতে বাদাম চাষ হয়। প্রতিবছর এ জমি থেকে প্রায় ৫০ হাজার মণ বাদাম উৎপন্ন হয়, যার আর্থিক মূল্য প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকা।
নেই তেমন পরিশ্রম ঃ
১০ থেকে ১৫ বছর আগেও কাজীপুরের চরবাসী বাদাম চাষে এতটা আগ্রহী ছিলেন না। তখন চরে অন্যান্য ফসলের সঙ্গে অপ্রধান ফসল হিসেবে বাদাম চাষ হতো। বর্তমানে বর্ষায় যে অনুপাতে পলি ও বালি জমা হয়, তাতে অন্যান্য ফসল উৎপাদনে জমি হয়ে উঠছে অনুপযোগী। তবে একই কারণে ওই জমিগুলোই হয়ে উঠছে বাদাম চাষের জন্য খুবই উপযোগী। এখন এক বিঘা জমিতে ধান বা অন্য ফসল চাষ করলে যে আয় হয়, তারই প্রায় সমান আয় হয় বাদাম চাষ করে। এলাকার কৃষকেরা জানান, চরের প্রায় সব জমিই এক ফসলি। আগে এসব জমিতে ধান, ডাল, তেলবীজ, পাট ও কিছু বাদাম উৎপাদন হতো। ১৯৮৮ সালের বন্যার পর চরের জমিগুলোয় পলি কমে বেলেমাটির পরিমাণ বাড়তে থাকে। এ বেলেমাটির কারণে জমি হয়ে ওঠে বাদাম চাষের জন্য দারুণ উপযোগী। বাদাম চাষে খরচ বাদে বিঘাপ্রতি সাড়ে থেকে ৫ হাজার টাকা আসছে। নাটুয়ারপাড়া ইউনিয়নের ঘোড়াগাছা গ্রামের কৃষক আব্দুল কালাম আজাদ, ফুলজোড় গ্রামের হাসেম আলীসহ বেশ কয়েকজন জানান, জমিতে হালকা চাষ দিয়ে বাদামবীজ ছিটিয়ে দিলেই হলো। তারপর কয়েক মাস বাদে জমি থেকে বাদামগাছ তুলে শেকড়ের সঙ্গে থোকায় থোকায় লেগে থাকা বাদামগুলো আলাদা করে নিলেই পাওয়া যায় ফসল। মাঝখানে জমিতে যেমন সার দিতে হয় না, তেমনি প্রয়োজন হয় না কোনো পরিচর্যার। তারপরও বিঘাপ্রতি বাদামের ফলন দেশের অন্য এলাকার চেয়ে বেশি। বাদামের মানও বেশ ভালো।
উৎপাদনঃ
কাজীপুর উপজেলা কৃষি অফিস চরে বিঘাপ্রতি ৫ মণ বাদাম উৎপাদনের কথা জানালেও কৃষকদের দাবি, প্রতি বিঘার উৎপাদনের পরিমাণ ৬ থেকে ৭ মণ। বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী প্রতি মণ বাদামের দাম প্রায় ৮শ’ থেকে ১ হাজার টাকা। প্রতি বিঘায় ৬ মণ বাদাম উৎপাদন হলে খরচ বাদে এ থেকে কৃষকের ঘরে আসছে বিঘাপ্রতি প্রায় ৫ হাজার টাকা। কাজীপুর উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মোজাম্মেল হক বকুল সরকার জানান, যমুনার চরে তার ১২ বিঘা জমি রয়েছে। ১০-১২ বছর তিনি এ জমি থেকে প্রতি মৌসুমে প্রায় ৭০-৭৫ মণ বাদাম পান। এ থেকে বছরে তার ৫০ হাজার টাকা আয় হয়।
আনন্দের ব্যস্ততা ঃ
মে-জুন মাস হলো বাদাম তোলার মৌসুম। এ সময়টা চরের প্রতিটি কৃষক পরিবারের কাটে বেশ ব্যস্ততার মধ্যে। জমি থেকে বাদাম তোলা, তোলা বাদাম কড়া রোদে শুকিয়ে বিক্রির উপযোগী করে বাজারে নিয়ে যাওয়াসহ নানা কাজে তাদের দম ফেলার ফুরসত থাকে না। তবে এ ব্যস্ততার মধ্যেও কৃষক পরিবারের প্রতিটি সদস্যর মুখেই হাসি লেগে থাকে। মৌসুমে কৃষক পরিবার ছাড়াও অন্যান্য পেশাজীবী পরিবারের নারী-শিশুদের মধ্যেও দেখা যায় অন্যরকম আনন্দ আর ব্যস্ততা। বাদাম তোলার কাজটি করে থাকে নারী ও শিশুরা। মালিকের কাছ থেকে খবর পেয়েই তারা ছুটে যায় বাদাম তুলতে। হালকাভাবে টান দিলেই উঠে আসে বাদামগাছ। জমির পাশে বসে বাদামগুলো বেছে আলাদা করে দিলেই গাছগুলো হয়ে যায় তাদের। গাছগুলো গোখাদ্য অথবা শুকিয়ে নেওয়ার পর জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
বাদামকে ঘিরে জমজমাট ব্যবসা ঃ
বাদাম ঘিরে নাটুয়ারপাড়া, তেকানী, কুমারিয়াবাড়ী, রঘুনাথপুর, জজিরা বাজারে গড়ে উঠেছে ব্যবসাকেন্দ্র। এসব জায়গা থেকে বাদাম নৌযান, ঘোড়ারগাড়ী, ট্্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহনে চলে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এতে অনেকের জন্যই সৃষ্টি হয়েছে কর্মসংস্থানের। নাটুয়ারপাড়া বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ীর দাবি, তাদের এলাকা এখন বাদাম বেচাকেনার সবচেয়ে বড় ব্যবসাকেন্দ্র। বেচাকেনা সারা বছর চললেও মৌসুমকে ঘিরে মে-জুলাই পর্যন্ত বিক্রি হয় সবচেয়ে বেশি। সরেজমিনে নাটুয়ারপাড়ায় গিয়ে দেখা গেছে, যমুনার পার থেকে শুরু করে বিশাল এলাকাজুড়ে বাদামের বড় বড় দোকান ও গুদামঘর। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ব্যবসায়ী (ক্রেতা) এবং স্থানীয় বাদাম চাষিদের (বিক্রেতা) ভিড়ে সেখানে হাঁটা-চলা করা কঠিন। ব্যবসায়ীদের কেনা বাদাম ঘোড়াগাড়ি, ট্্রাক ও যন্ত্রচালিত নৌকায় চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। আড়তদার হামিদ সরকার, মিলন সরকারসহ বেশ কয়েকজন জানান, বাদাম তোলার মৌসুমে প্রত্যেক হাটবারে সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, জামালপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বহু ব্যবসায়ী আসেন। প্রত্যেক হাটে কমপক্ষে ৫০টি নৌকা বোঝাই হয়ে বাদাম চলে যায় দেশের বিভিন্ন এলাকায়।
বাদামে কর্মসংস্থান ঃ
এ বাদাম উপজেলার আরও কয়েক শ’ মানুষ বিশেষ করে নারীদের সচ্ছলতা এনে দিয়েছে। নাটুয়ারপাড়া, মনসুরনগর, খাসরাড়ী, নিশ্চিন্তপুর, চরগিরিশসহ বিভিন্ন এলাকার নারীরা বাদাম থেকে খোসা ছাড়ানো, বাদাম ভাজাসহ বাদামজাত নানা খাদ্যসামগ্রী তৈরি করছেন। তৈরির পর তা চলে যাচ্ছে সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, জামালপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। দেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নাটুয়ারপাড়া থেকে খোসা ছাড়ানো বাদাম নিয়ে যায়।
বাদামে স্বপ্ন বুণন ঃ
ভাঙন তান্ডবে নিঃস্ব-রিক্ত অনেক পরিবার এখন বাদাম চাষে দেখতে পাচ্ছেন আশার আলো। কাজীপুর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান সুলতানা হক ও মনসুরনগর ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক রাজমহর জানান, নদীভাঙনে জমি-জমা হারিয়ে বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ অথবা পরাশ্রয়ে যারা বসবাস করছিলেন, চরে জমি ফিরে পেয়ে বাদাম চাষ করে তাদের কেউ কেউ ইতোমধ্যেই জায়গা কিনে বাড়িঘর বানিয়েছেন। অনেকেই আবার স্বপ্ন দেখছেন নিজের নতুন বাসস্থানের। চরের বাসিন্দা কাজীপুর উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ বকুল সরকার তার অফিসে পরিচয় করিয়ে দেন যমুনার ভাঙনে সবকিছু হারিয়ে শুভগাছা, মেঘাই, সিমান্তবাজার ও ঢেকুরিয়া বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধে বাস করা নজরুল ইসলাম, বাদশা, নূরুল ইসলাম, আল-আমিন, আব্দুল হাকিম, মতিন সরকার, আজিবার রহমান, হোসেন আলীসহ কয়েকজন ভাঙন দুর্গতকে। গত কয়েক বছরে এদের সবারই কিছু কিছু জমি যমুনায় জেগে উঠেছে। সেখানে বাদাম চাষ করে তারা ফিরে পেয়েছেন সচ্ছলতা। এখন তারা টাকা জমিয়ে তাদের কাক্সিক্ষত স্বপ্নের পথে হাটছেন।