মৃত্যুকে খুব কাছে থেকে দেখে ফিরেছি

নিউজ ডেস্ক.

মৃত্যু এমনই এক রহস্যঘেরা জগত যেখানে আমরা কেউই পা রাখতে চাই না! কিন্তু মৃত্যুকে মুঠো করে যেন হাঁটছি প্রতিটা দিন, প্রতি মুহূর্ত! সোমবার দুপুরে স্ত্রী-সন্তানের কাছে হাসিমুখে বিদায়ের সঙ্গে ছিল রাতে বাসায় ফেরার প্রতিশ্রুতি। আমার তিন বছর বয়সী মেয়েটা প্রতিদিনের মতো হাতে চুমু এঁকে বলল ‘বাবা রাতে দেখা হবে।’ রাত নয়; বিকেল গড়াতেই ফিরে এলাম। কিন্তু সেখানে সেই হাসিমুখের বদলে মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখার দুঃসহ এক স্মৃতি নিয়ে! মাথা ঘুরছে। কাঁপছি আমি। ঘামছি পৌষের এই শীতেও!
প্রতিদিনের মতো ঠিক দুটো বাজতেই আমি পৌঁছে গিয়েছিলাম আমার কর্মস্থল; বনানীর বসতি হরাইজনের পরিবর্তন ডটকম অফিসে। নয় তলায় পৌঁছে কম্পিউটার ওপেন করে কাজ শুরু করার প্রস্তুতিটাও নিচ্ছিলাম। ঠিক তখনই সেন্ট্রাল ডেস্কের বিউটি হাজংয়ের চিৎকারে চোখ তুলে তাকালাম। অফিসের নীচ থেকে আরেক সহকর্মী ওয়ারেসুন্নবীর ফোন কল, তাড়াতাড়ি আপনারা নীচে নেমে আসুন, আমাদের অফিসে আগুন লেগেছে!’
কারওয়ান বাজারে বিএসইসি ভবনের আগুনের ভয়াবহতার অভিজ্ঞতা ছিল বলেই- এক মুহূর্ত দেরি করলাম না। সহকর্মী তুহিন ভাইকে ডাক দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পরিবর্তন অফিসের দরজা খুলতেই বাইরে সিঁড়িতে এসে আঁচ করতে পারি, ভয়াবহ এক বিপদ ওঁৎ পেতে আছে আমার সামনে!
কী করবো, কী করা উচিত ভাবতে ভাবতেই প্রচণ্ড ধোঁয়া কাবু করে ফেললো। সঙ্গে কবরের অন্ধকার! আর মানুষের ভয়ার্ত কণ্ঠ। কেউ বললেন- চলুন, আমরা নিচে নেমে যাই। ধোঁয়া ভেঙে সেই চেষ্টাটাই চললো। স্রোতের সারির মতো আমরা রওনা দিলাম, নয় তলা থেকে নিচে।
দু’ তলা নামতেই মোবাইলের লাইটে চোখে পড়ল এক পরিচিত মুখ। আমাদের গ্রাফিক্স হেড ফরিদ। চরম সাহসিকতায় এই মানুষটি সবাইকে বললেন, ‘নিচে আগুন লেগেছে। চলুন, আমরা বরং ছাদে উঠি।’ মানুষের স্রোত তখন চললো ছাদে। সঙ্গে নারী কণ্ঠে কান্না শুনে গা শিউরে উঠলো!
প্রাণ বাঁচাতে আমরা উঠে এলাম সম্ভবত ১৩ তলায়। এখানেও প্রচণ্ড ধোঁয়া। নাক বন্ধ হয়ে আসছে। পাশেই একজনকে আবছা আলোয় দেখলাম, বমি করছেন। এমন ভয়াবহ অন্ধকারে ধোঁয়ার কারণে কেউ মনে হলো সিঁড়িতে পড়েও গেলেন। কাউকে বলতে শুনলাম, ওপরে ১৬ তলাতেও আগুন!
এবার সত্যি সত্যিই মরণ-ভয় পেয়ে গেল! না, রাতে বুঝি আর প্রিয়জনের কাছে ফেরা হবে না আমার। আমার ছোট্ট সেই কন্যাটিকে, যাকে দেখে শত যন্ত্রণা ভুলে যাই আমার সেই লাইফলাইনকে আমি আর দেখবো না! এমন ভাবনা আমার ভীতু মনটাকে দুমড়ে-মুছড়ে দিচ্ছে ঠিক তখনই আবারো সেই ফরিদের চিৎকার। ‘ভাইয়েরা, আপনারা ভয় পাইয়েন না। জীবন বাঁচাতে হলে আমাদের এখন যে কোনো একটা অফিস রুমে ঢুকতে হবে।’
অন্ধকারে কোনো এক অফিসের দরজায় নক করা শুরু হলো। ভেতর থেকে লক করা! আমরা চিৎকার করছি, দরজা খুলছে না! আহ! আমাদের বুঝি এই সিঁড়িতেই ধোঁয়ার কুণ্ডুলিতেই প্রাণ যাবে! নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, চোখে তো কিছুই দেখছি না! ঠিক তখনই দরজা খুলে গেল!
আমরা অচেনা কিছু মানুষ সেই অফিসে ঢুকে পড়লাম। সেখানেও ধোঁয়া। কেমন যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসা ধোঁয়া! একটু স্বস্তি খুঁজতে ১৩ তলার সেই অফিসের বারান্দায় ছুটলাম। সেখানেও মানুষ। বিভিন্ন অফিসের। এরই মধ্যে পরিচিত তিনজনকে পেয়ে যেন সেই দুঃসহ মুহূর্তে কিছুটা স্বস্তি মিললো। অসীম সাহসী ফরিদের সঙ্গে আইটির হেড সগীর আর নির্বাহী পরিচালক মুক্তি ভাই (মুক্তি হাসিবুর রহমান)।
বদ্ধ সেই ঘরে যেন আরেক নরক যন্ত্রণা। ওপরে সেই রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচে দেখলাম শত শত মানুষ। ভয়টা তখন আরো বেড়ে গেল। বুঝতে পারছিলাম ভয়াবহ এক অভিজ্ঞতা কিংবা মৃত্যুই বুঝি অপেক্ষা করছে। হয়তো সেটা কিছুক্ষণ পরই।
চোখের সামনে ভাসতে থাকল প্রিয় মানুষের মুখগুলো। পাশ থেকে কেউ একজন কান্না জুড়ে দিলেন। ভাইকে ফোন দিয়ে আহাজারি করে বলছিলেন, ‘আমারে মাফ কইরা দিসরে ভাই। মনে হয় একটু পরই আগুনে পুড়ে মারা যামু। তুই আমার সন্তানটারে দেইখা রাখিস।’
বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো। আমার রূপকথা আমার সন্তান জারা’র মুখ মনে পড়ে গেল। বাবাকে ছাড়াই তাহলে বেড়ে উঠতে হবে ওর! কোনো স্মৃতিই বুঝি পাবে না বাবার! আশপাশে দাঁড়ানো অনেকেই ফোনে তাদের পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিলেন। যাকে বলে শেষ বিদায়।
আমি কাঁপছি। ভয়ে নীল হয়ে যাচ্ছি। মোবাইলে সহকর্মী মেহেদী হাসানের মেসেজ আসছে, ‘ভাই ফায়ার সার্ভিস এসেছে। চিন্তা করবেন না। আগুন নেভানোর ব্যবস্থা হচ্ছে।’ আরেফিন আশ্বস্ত করে, ‘ভাই ভয় পাবেন না। কিছু হবে না। আগুন নেভানো হচ্ছে।’
আমি আশ্বস্ত হতে পারি না। ধোঁয়া যে কমে না। একবার ভাবি স্ত্রী- যাকে সারা জীবন পাশে থাকবো বলে কথা দিয়েছি, তার কাছ থেকে শেষ বিদায়টা নিয়ে নিই। মিনিট দশেক পর হয়তো সেই সুযোগটাও পাবো না। নিচ থেকে ধোঁয়া আসছে।
ঠিক তখনই একটু সাহস দেখাতে চাইলাম। আবার সিঁড়ির দিকে যেতে চাইলাম। কিন্তু দরজা খুলতেই কুণ্ডুলি পাকানো কালো ধোঁয়া আর পোড়া গন্ধে প্রাণ-জ্ঞান হারাতেই যাচ্ছিলাম। দ্রুত আবার দরজা বন্ধ করে ফিরলাম। এবার পাশের আরেক রুমে। যেখানে এসে দেখা হয়ে গেল পরিবর্তনের আরেক সহকর্মী নীলসাগর গ্রুপের মিডিয়া সিইও রাজিব-উন-নবী রবিন ভাইয়ের সঙ্গে।
এমন দুঃসহ অভিজ্ঞতার মুখে দাঁড়িয়েও উনাকে বেশ অবিচল দেখে সাহস জমতে থাকলো মনে। চটজলদি বুদ্ধি বের করে রবিন ভাই কাচের জানালা খুলে ফেললেন, যাতে ধোঁয়া দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। নিচে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির সাঁইরেন শুনছি। তারপরও মনে হচ্ছে মৃত্যু বুঝি আজ রেহাই দিচ্ছে না। এরই মধ্যে গুঞ্জন শুনলাম, আগুন নাকি ১৬ তলাতেও ছড়িয়ে পড়েছে!
’তাজরিন গার্মেন্টের সেই পুড়ে যাওয়া ‘স্বস্তা’’ শ্রমের শ্রমিকের মতোই মনে হলো নিজেকে। আজ বুঝি আমারও সেই একই পরিণতি হতে যাচ্ছে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে চোখ মুছতেছিলেন নীলফামারি থেকে আসা আমাদের ছোট্ট সহকর্মী আজিজুল। আবার অসীম সাহসী কাউকে দেখলাম, কার্নিস ধরে পাশের বিল্ডিংয়ে আশ্রয় নিচ্ছে। ১৩ তলার ওপরে এমন ঝুঁকি আমি অন্তত নিতে পারবো না। বাইরে বের হবো, সেই উপায়ও নেই!
বুক ভেঙে কান্না আসছিল। কাল আমাকে ছাড়াই আরেকটা সূর্যোদয় হবে। আমার জন্য পত্রিকায় শোকগাথা লিখবে আমারই কোনো এক বন্ধু। হয়তো একসময় প্রকৃতির নিয়মেই ভুলে যাবে আমাকে। আর আমার পরিবার? এই যন্ত্রণা বয়ে বেড়াবে আজীবন! আমি-হীন বেঁচে থাকার যন্ত্রণা না জানি কেমন!
পাশের নরডিক হোটেল থেকে ফায়ার সার্ভিসের একজন মাইকে বলতে থাকলেন, ‘আপনারা আতঙ্কিত হবেন না। আগুন নিভে গেছে!’ এমন কথাও স্বস্তি দিচ্ছিল না। এরই মধ্যে মুখ-শরীর কালো কালিতে একাকার। রবিন ভাই মুঠো ফোনে খবর দিলেন আগুন নিভে গেছে। ধোঁয়ার মাত্রাটাও কমে এসেছে!
কেউ একজন জানালেন, পাশের অ্যামরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিল্ডিং থেকে রেসকিউ করা হচ্ছে আমাদের। খবর শুনেই হুড়োহুড়ি শুরু হলো। জীবনটাতো বাঁচাতে হবে। ছুটলাম আমিও। পাশের বিল্ডিং থেকে একজন হাত বাড়িয়ে দিলেন। বললেন, ‘আমার হাতটা ধরুন।’ পাশের বিল্ডিংয়ে জাম্প দেবো? সাহস হচ্ছিল না। কিন্তু তখনই প্রিয়জনদের মুখটা ভেসে উঠল আবারো। চোখ বন্ধ করে সেই মানুষটির হাতে হাত রাখলাম।
তারপরই বুঝতে পারলাম, এ যাত্রা বোধ হয় বেঁচে গেছি। ১৩ তলা থেকে সিঁড়িতে নামতে নামতে ফোনের কি-বোর্ডে হাত রাখলাম। এবার অন্তত আমার স্ত্রী-কে জানানো যায়, ‘আমি মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখে ফিরছি। ফিরছি তোমাদের কাছে!’
না ফেরার দেশে একদিন আমাদের সবাইকেই চলে যেতে হবে। মরণের হাত থেকে রেহাই নেই! কিন্তু মৃত্যুর আগেই নরক যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা সঙ্গী হলো। গায়ে লেগে থাকা কালো ধোঁয়া তুলে ফেলেছি একটু আগে। এখনো হাত পা কাঁপছে। প্রিয়জনদের কাছে ফিরে এসেছি, সুস্থ আমি। কিন্তু মনের গহীনে যে ভয়, আর যন্ত্রণা লেগে গেছে তা বুঝি সহজে মুছে যাবে না!
হোটেল সারিনার পাশে দাঁড়িয়ে বিধ্বস্ত আমি ভাবছিলাম- টাকা পয়সা, গাড়ি, বাড়ি, খ্যাতি কিংবা অহংবোধও নয়, দিনশেষে প্রিয়জনের কাছে সুস্থ দেহে ফিরতে পারাটাই সত্যিকারের সুখ! বেঁচে আছি এর চেয়ে বড় কিছু আর হয় না!

অনুমতি ব্যতিত কপি করা থেকে বিরত থাকুন। -ধুনট বার্তা কর্তৃপক্ষ