Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/dhunatbarta.net/public_html/wp-content/plugins/social-share-with-floating-bar/social-share-with-floating-bar.php on line 820
কাজীপুর (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি.
ওরা ঘাসুড়ে । ওদের জীবন চলে ঘাস বিক্রির টাকায় । যমুনার জেগে ওঠা চরের নানা ঘাস ও কাইশা সংগ্রহ করে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে দিন শেষে চাল-ডাল ,তেল, লবন নিয়ে যখন বাড়ি ফেরে তখন ওদের ক্লান্ত শরীর কেবলই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যেতে চায় ।
কোন রকমে চাল ফুটে ভাত বেরুলেই বউ-ছেলেপুলে নিয়ে খেয়ে চাটাইয়ের বিছানায় শুয়ে ঘুম । পরদিন সূর্যের আলো ফোটার সাথে পাল্লা দিয়ে আবার ঘাস কাটার প্রস্তুতি । রোজগার বেশি করতে অনেকে তাদের ৫/৭ বছরের ছেলে-মেয়েদের সাথে নেয় । এমনি করেই বেশ ক’বছর ধরে চলছে যমুনা পাড়ের শ’ পাঁচেক হত-দরিদ্র ভাঙ্গন কবলিত পরিবারের জীবন-জীবিকা। দিগন্ত-বিস্তৃত সবুজ-সোনালি ফসলের ক্ষেতে ওদের ছিল নিরঙ্কুশ প্রাধান্য । ওরা সবুজের মাঝে কাস্তে-মানুষদের জীবন। ওদের পিতা-মাতার দেয়া নামের সাথে এখন যোগ হয়েছে ঘাসুড়ে নামটি। ওরা ঘাসুড়ে ।
এক সময়ে ওদেরও গোয়াল ভরা ছিল গরু ,গোলাভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ। ছিল অনেক জায়গা-জিরাত । অভাব শব্দটি ছিল ওদের কাছে অনুপস্থিত। যমুনার টাটকা মাছ ,আবাদের শাক-সবজি আর গাভীর খাঁটি দুধের সাথে গাইনজা (চিকন চাল বিশেষ যা যমুনার চরে জন্মে ) চালের ভাত খেয়ে ওরা অভ্যস্ত ছিল পাচুন (কৃষি কাজে ব্যবহৃত যন্ত্র বিশেষ ) দিয়ে যখন মাঠের পর মাঠ নিড়ানি দিত তখনও কি ওরা জানত এই স্বপ্নেরও একদিন করুণ পরিণতি হবে ? দুপুরে খাবার নিয়ে যখন ওদের বউ-ঝিরা জমিতে যেত তখনও কি যমুনার আগ্রাসি রূপ ওদের বউদের রূপকে ম্লাণ করে দেবে তা ভাবনায় ছিল ? না । নিশ্চয় এমন চিত্র ওদের ভাবনায় থাকার কথা নয়। অথবা দুপুরের ধুয়া বা জারি গানের সুর যতদূর যেত, ওতদূর কি ওদের দুঃস্বপ্ন পৌঁছাতে পারতো ?
উত্তর না মিললেও আজ এমনটিই বাস্তব ;ওরা ঘাসুড়ে। সর্বগ্রাসি যমুনা ওদের সব নিয়েছে। পুরোনো পেশা বদলে ওদেরকে নতুন পেশা উপহার (?) দিয়েছে । ওদের সব পরিচয় ছেপে একটিই পরিচয় সবার মুখে মুখে। নাতি – নাতনিদের সাথে মজার মজার গল্প আর আড্ডায় অলস সময় পার করা দাদা-নানারাও আজ বেচেঁ থাকার তাগিদে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘাস সংগ্রহে ব্যস্ত। নইলে যমুনার মত ক্ষুধাও যে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। তাইতো কয়েক বছরের ব্যবধানে স্বচ্ছল সুখী পরিবারের সদস্যদের আজ বেহাল দশা ।
দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের জন্য ছেলে-বুড়ো এমনকি আদরের ছোট ছেলে-মেয়েদের সাথে নিয়ে শ্রম বিক্রির পাশাপাশি যমুনার চর থেকে সংগৃহিত ঘাস হাট – বাজারে বিক্রির টাকায় ওদের সংসার চলে । ঢেকুরিয়া গ্রামের ঘাসুড়ে আব্দুল গণি (৭০) তাদেরই একজন । সর্বনাশা যমুনা নদীর ভাঙ্গনে সহায় সম্বল ভিটে মাটি হারিয়ে এখন বন্যা নিয়ন্ত্রন বাধে ঝুঁপড়ি ঘরে পরিবার-পরিজন নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে ।
মাইজবাড়ি গ্রামের আমির হোসেন ,রোস্তম আলী, বিলচতল গ্রামের শাহজাহান আলী ও নুরুল ইসলামের মতো প্রায় পাঁচ শতাধিক পরিবারের জীবন চলে এখন ঘাস সংগ্রহ ও বিক্রি করে। যমুনা নদীর পুর্ব পাড়ে জেগে ওঠা কয়েকটি চরে জন্ম নেওয়া কাইশা ও বিভিন্ন জাতের ঘাস এখন ওদের বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা। এক সময়ের প্রতাপশালী গৃহস্ত ভাঙ্গারছেঁও গ্রামের নূরুল মিয়া জানায়, একযুগ আগে তার সোনায় মোড়ানো সংসার ছিল । তিনজন বছরশাইল ( এক বছরের চুক্তি ) কাজের লোক ছিল । এক বছরে তার সব জমি যমুনার পেটে যায় । লেখাপড়া করেনি বলে নতুন কর্মসংস্থান করতে পারেনি । আজ সে নিঃস্ব । নিজে এখন শ্রম বিক্রি ও ঘাসুড়ে হয়ে পরিবারের ভরণ-পোষন জোগাচ্ছেন ।
বর্তমানে ক্ষেত – খামারে তেমন কাজ না থাকায় ৭ বছরের ছেলেকে সাথে নিয়ে যমুনার চর থেকে ঘাস তুলে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ওয়াপদা বাঁধ ও এর আশেপাশে আশ্রয় নেয়া এমন বহু নুরুল মিয়াদের দেখা মিলবে। কাক ডাকা ভোরে যমুনা নদী পার হয়ে পুর্ব পাড়ে জেগে ওঠা ফুলজোড়, চরমাইজবাড়ি, মল্লিকপাড়া ,সুতানাড়া, বিলধলী, ভাঙ্গারছেঁও সহ বিভিন্ন চর থেকে সারাদিন ঘাস সংগ্রহ করে হাটে বিক্রি করে চাল ,ডাল নুন ,তেল নিয়ে তারা বাড়ি ফেরে। ঘাসুড়ে আমির আলী জানান ,প্রতিদিন নদী পারাপার বাবদ ২০ টাকা খরচ বাদে সংগ্রহ করা ঘাস বেচে আড়াইশ থেকে ৩শ টাকা পান ।
এলাকার ডাকসাইটের এক মাতব্বরের ছেলে শুকুর আলী লোক লজ্জার ভয়ে পরের বাড়িতে দিন মজুরি না করে একটি ডিঙ্গি নৌকা বানিয়ে নিয়েছেন । ওই নৌকা নিয়ে নদী পার হয়ে তিন ছেলেসহ তিনি, প্রতিদিন যে ঘাস সংগ্রহ করেন নিজের একটি গাভীর জন্য রেখে বাকি ঘাস প্রায় ৬শ থেকে ৭শ টাকায় বিক্রি করেন। খেয়ার নৌকায় পারাপারে নানা রকম ঝামেলা ও সময় অপচয় হওয়ার কারনে তার মতো আরো অনেকে ডিঙ্গি নৌকা বানিয়ে নিয়েছেন।
এবার বন্যায় চর ডুবে কাইশাসহ অন্যান্য ঘাস পানিতে পঁচে যাওয়ায় বর্তমানে ঘাস কম পাওয়া যাচ্ছে বলে সে জানায়। বর্তমানে কাজীপুরের যমুনা ভাঙ্গনে নিঃস্ব প্রায় ৫শতাধিক মানুষ ঘাস সংগ্রহ ও বিক্রয় করার কারনে এলাকায় ছোট বড় বেশক’টি গরুর খামার গড়ে উঠেছে। চাহিদা বাড়ার কারনে বিলচতল ওয়াপদাবাধ, ঢেকুুিরয়া, মেঘাই, শামপুর ও শিমূলদাইড় বাজারে ঘাস বিক্রির হাট বসে। যোগযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় ঢেকুরিয়ায় সকাল বিকাল ঘাস কেনা বেচা হয় ।
এসব হাট থেকে স্থানীয় গৃহস্ত ও খামারিদের পাশাপাশি দুর – দুরান্ত থেকে ছাগল-গরু-মহিষ পালনকারিরা এসে ঘাস কিনে নিয়ে যায়। বিলচতল গ্রামের খামারি ইউপি সদস্য আব্দুস সালাম জানান, নেপিয়ার ঘাসের পরিবর্তে যমুনার চরের প্রকৃতির ঘাস খেয়ে তার গাভী বেশী দুধ দিচ্ছে। তিনি এখন গোখাদ্যের জন্য প্রতিদিন যমুনার ঘাস ক্রয় করেন ।
মাইজবাড়ি ইউপির দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারি পশু চিকিৎসক বাবু সূর্যকান্ত সরকার জানান, যমুনার চরের ঘাস খাওয়ানোর ফলে গবাদি পশুর রোগ-বালাইও অনেক কম হয় ।